Saturday, August 13, 2011

পুলিশের নৃশংসতা বেড়েই চলেছে ভেঙে পড়েছে চেইন অব কমান্ড নাছির উদ্দিন শোয়েব - আমার দেশ

পুলিশের নৃশংসতা বেড়েই চলছে। ভেঙে পড়েছে চেইন অব কমান্ড। পুলিশ বাহিনীতে অনেকটা বেসামাল অবস্থা। রাজনৈতিক দল দলনেই পুলিশের অতিউত্সাহ একের পর এক বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। এতে এই বাহিনী এখন ব্যাপকভাবে সমালোচিত। নিরপরাধ মানুষের ওপর পুলিশি নির্যাতনে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে মানবাধিকার। সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত কয়েকটি ঘটনায় পুলিশের উচ্ছৃঙ্খল আচরণ ও বেআইনি কর্মকাণ্ডে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও হতাশ ও ক্ষুব্ধ। পুলিশের নির্যাতনের কয়েকটি ঘটনায় আদালত রুল দিতে বাধ্য হয়ছেন। ঘটনা তদন্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে গঠন করা হয়েছে কমিটি। সাসপেন্ডসহ বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। পুলিশের প্রতি আস্থা না থাকায় নির্যাতনের কয়েকটি ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্ত শুরু করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরে দফায় দফায় বৈঠক করেও কাজ হচ্ছে না। কোনো অবস্থাতেই শৃঙ্খলা ফিরে আসছে না পুলিশ বাহিনীতে।
সুপ্রিমকোর্টের খ্যাতনামা আইনজীবী অ্যাডভোকেট এমইউ আহমেদকে আটক এবং নির্যাতনের কারণে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আব্দুল কাদেরকে আটকের পর ডাকাত সাজিয়ে নির্যাতন, নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জে ডাকাত সন্দেহে কিশোর মিলনকে পিটিয়ে হত্যা, আমিনবাজারে ছয় ছাত্রকে গ্রামবাসী কর্তৃক পিটিয়ে হত্যার ঘটনা তদন্তে স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদের পক্ষে পুলিশের অবস্থান, এর আগে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর বর্বরোচিত হামলা, হরতালে মিছিলে অংশ নেয়া নারীদের ওপর পুলিশের ঝাঁপিয়ে পড়া এবং বেধড়ক লাঠিপেটা, বিরোধী জোটের রাজনৈতিক নেতাদের আটকের পরই রিমান্ড ও টিএফআই সেলে নিয়ে নির্যাতন, দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে আটক করতে এসে পত্রিকা অফিসে হামলা ও পুলিশের যুদ্ধংদেহী আচরণ, সম্পাদককে টিএফআই সেলে নিয়ে নির্যাতন, সম্প্রতি অনলাইন সংবাদ সংস্থা শীর্ষ নিউজ ও শীর্ষ কাগজের সম্পাদক একরামুল হককে আটক করে চোর-ডাকাতের মতো হাতকড়া পরিয়ে আদালতে হাজির এবং পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
জয়নুল আবদিন ফারুকের ঘটনা তদন্তে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল জলিলকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তদন্তের ফলাফল এখনও আলোর মুখ দেখেনি। এ ঘটনায় উল্টো পুলিশ বাদী হয়ে ফারুকসহ ১২/১৩ জন আইনজীবীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। আর হামলাকারী পুলিশ সদস্য এডিসি হারুন ও এসি বিপ্লব কুমার সরকার চিকিত্সার নামে হাসপাতালে ভর্তি হয়। কিছুদিন আগে এডিসি হারুন ১৫ দিনের ছুটি নিয়ে আমেরিকা গিয়ে এখনও ফিরে আসেনি। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুল কাদেরের ডাকাতির ঘটনা মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় খিলগাঁও থানার ওসি হেলাল উদ্দিন, এসআই আলম বাদশা এবং এএসআই তৌহিদুর রহমানকে হাইকোর্টের নির্দেশে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে আইন সচিবকে এ ঘটনা তদন্তের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। কোম্পানীগঞ্জে পুলিশের সহযোগিতায় কিশোর মিলনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি রফিক উল্লাহসহ ৪ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার জেলা পুলিশ সুপার হারুন-উর-রশিদ হায়দারী জানিয়েছেন, এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। কমিটির প্রধান মাহবুব রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, প্রতিবেদনের সার-সংক্ষেপ হলো—‘দায়িত্ব পালনে পুলিশের গাফিলতি।’ তারা মিলনকে রক্ষায় যথাযথ দায়িত্ব পালন করেনি। এজন্য ওসি রফিক উল্লাহ, এসআই আকরাম শেখ ও দুই কনস্টেবল আবদুর রহিম ও হেমারঞ্জন চাকমার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছেন, মুষ্টিমেয় কিছু সদস্য ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তবে পুলিশ সদস্যরা সততা, নিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। যাদের বিরুদ্ধে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সাভারের আমিনবাজারে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরের ঘটনায় পুলিশের বিভাগীয় পর্যায়ে তদন্ত চলছে। কাদেরের ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে তার দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পরই প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে। তবে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন এবং প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু বরাবরই বলছেন, এগুলো বিচ্ছিন ঘটনা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে, ‘আমার পুলিশ বাহিনী’ কখনও শৃঙ্খলা ভঙ্গ করতে পারি না। যদি এরকম কিছু হয়ে থাকে তবে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, আদালতের নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এপর্যন্ত আলোচিত কোনো ঘটনায়ই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা পুলিশ সদর দফতর থেকে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
ঢাবি ছাত্র কাদের প্রসঙ্গে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান আদালতে উপস্থিত হয়ে বলেছেন, পুলিশ কাস্টডিতে নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্মমভাবে নির্যাতন করেছে। এটা লজ্জাজনক। তিনি বলেন, কিছুদিন আগে একজন পুলিশ বলেছে, পুলিশকে লাঠি দেয়া হয়েছে কি চুমো খাওয়ার জন্য? জনগণের স্বার্থরক্ষার জন্য। সেই লাঠিকে ব্যবহার করা হয়েছে একজন ছাত্রের ওপর। তার মানবাধিকার ও সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। ওসি বলেছেন, গণপিটুনিতে আহত হয়েছে। তবে যারা গণপিটুনি দিয়েছে, তাদের ধরা সম্ভব হয়নি। বারবার এই গণপিটুনির কথা বলে ৫ জন, ৬ জন করে হত্যা করা হলো। এতে গণপিটুনি বৈধতা পাচ্ছে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা যদি গণপিটুনিকে বৈধতা দেয়ার কাজে উত্সাহ দেন, তাহলে রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোথায় যাবে? এ সময় আদালত বলেন, পুলিশের মানুষকে পেটানোর কোনো অধিকার নেই। পেটানোর দায়ে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে।
এমইউ আহমেদ হাসপাতালে : পুলিশের অমানবিক নির্যাতনে আশঙ্কাজনক অবস্থায় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে চিকিত্সাধীন আছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এমইউ আহমদ। হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সংশ্লিষ্ট চিকিত্সক বলছেন, এমইউ আহমেদের জীবন সঙ্কটাপন্ন। তিনি হাইরিস্ক পেশেন্ট। ৭২ ঘণ্টা পার না হওয়া পর্যন্ত তার অবস্থা সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না। গত বুধবার রাত দেড়টায় সাদা পোশাকধারী পুলিশ এমইউ আহমেদকে তার ১১৬, সেগুনবাগিচার বাসা থেকে গ্রেফতার করে। পরিবারের অভিযোগ, গ্রেফতারের সময়ই তাকে কিলঘুষি মারা হয়। তছনছ করা হয় বাড়ির মালামালা। গ্রেফতারের পর কিলঘুষি মেরে গাড়িতে ওঠায় ডিবি পুলিশ। পরে নেয়া হয় মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে (ডিবি)। সেখানে তাকে আরও নির্যাতন চালানো হয় বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। তারা জানান, নির্যাতনের একপর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরদিন ভোরে তাকে অজ্ঞান অবস্থায় ডিবি পুলিশ নিয়ে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত ডাক্তাররা অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে তাকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নেয়ার পরামর্শ দেন। বর্তমানে হাসপাতালে গভীর পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে তাকে। তবে ডিবি পুলিশের এডিসি মেহেদি হাসান সাংবাদিকদের জানান, অ্যাডভোকেট এমইউ আহমদকে নির্যাতন করা হয়নি। পুলিশ আটক করে গাড়িতে তোলার পরই তিনি জানান, তার বুকে ব্যথা হচ্ছে।
কণ্ঠশিল্পী রিজিয়া পারভীনের অভিযোগ : পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগে সংবাদ সম্মেলন করেছেন কণ্ঠশিল্পী রিজিয়া পারভীন। পুলিশি হামলার প্রতিবাদে গত ১৬ জুন রাজধানীর একটি রেস্তোরাঁয় সংবাদ সম্মেলনে তিনি অভিযোগ করে বলেন, ১২ জুনের হরতালে জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংগঠনের (জাসাস) একটি মিছিলে অংশ নেয়ায় পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন তিনি। ওই দিন বেলা ১২টার দিকে জাসাসের একটি শান্তিপূর্ণ মিছিল পেট্রোবাংলা কার্যালয় থেকে এফডিসির গেটের সামনে গেলে হঠাত্ করে পুলিশ আক্রমণ করে। এ সময় পুলিশ মধ্যযুগীয় কায়দায় তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রিজিয়া পারভীন অভিযোগ করেন, পুলিশ হাত ধরে টানাহেঁচড়া করে তার সম্মানহানি করেছে। তিনি বলেন, বর্তমানে আমি শারীরিকভাবে গুরুতর অসুস্থ। আমার ওপর কেন এই নির্যাতন? একজন শিল্পীর ওপর হামলার ঘটনা গোটা জাতির জন্য লজ্জাজনক। সবাই মিলে এর প্রতিকার করা উচিত। এর আগে বঙ্গোপসাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে মার্কিন কোম্পানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাতিলের দাবিতে কর্মসূচি দেয়ায় কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের ওপর হামলা চালায় পুলিশ। এ ঘটনায় ঢাকায় হরতাল পালন করা হলে সেখানেও পুলিশ হামলা করে। অন্যদিকে আমেরিকায় চিকিত্সা নিতে যাওয়ার আগে জয়নুল আবদিন ফারুক বলেছেন, পুলিশ হত্যার উদ্দেশ্যে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তিনি আত্মরক্ষার জন্য দৌড়ে ন্যামভবনের একটি কক্ষে গিয়েও তাদের হাত থেকে রক্ষা পাননি। ন্যাম ভবনের ফ্ল্যাট থেকে টানাহেঁচড়া করে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপকে বিবস্ত্র্র করে লাঠিপেটা করেছে। তবে সেদিনের পুলিশের বেসামাল হামলার দৃশ্য মিডিয়ায় ফলাওভাবে প্রচার হওয়ায় দেশে-বিদেশে বহু লোক তা প্রত্যক্ষ করেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার কারণে পুলিশের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। পুলিশ বাহিনীতে দলীয় পরিচয়ে নিয়োগ দেয়ার ফলে তারা কমান্ড মানছে না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পুলিশ বাহিনীতে দুটি বিশেষ এলাকার লোকদের প্রাধান্য দিয়ে নিয়োগ দেয়া হয়। বর্তমানে পুলিশের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্তদের বেশিরভাগই গোপালগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলার বাসিন্দা। এই দুই অঞ্চলের বিশ্বস্ত এবং অনুগত পুলিশ সদস্যরা গুরত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। এসব পুলিশ সদস্যের সঙ্গে মন্ত্রী, এমপি, উপদেষ্টাদের সরাসরি যোগাযোগ থাকায় তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশনাও উপেক্ষা করে চলছে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ওইসব দলীয় পৃষ্ঠপোষক পুলিশ সদস্যরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশনাও সঠিকভাবে মানছেন না । কেননা তারা একাধিক নেতা, মন্ত্রী ও এমপির আশীর্বাদপুষ্ট। তাদেরকে সহজেই বদলি ও শাস্তিও দিতে ব্যর্থ হচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রসঙ্গত, গত হরতালে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর হামলাকারী দুই পুলিশ কর্মকর্তাই কিশোরগঞ্জের বাসিন্দা। এখন পর্যন্ত ওই ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদ্বয়ের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

সমাজের অন্ধকারে বিপন্ন মানুষ

আবুল কালাম আজাদ
১৯৯১ সালের নির্বাচনে আমাকে বহনকারী জিপ গাড়িটি সহযাত্রীসহ পুকুরের পানিতে ডুবে গিয়েছিল। অল্পের জন্য সেদিন আমি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম। দীর্ঘদিন নির্বাচনী প্রচারণার সময়ে আমার উপজেলার বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার ফলে নিজের নির্বাচনী এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার নানা কাহিনী, দুঃখ, বেদনা, অব্যক্ত কথা, অব্যক্ত মর্মবেদনা, না বলা রূঢ় বাস্তবতার নির্মম কাহিনী শুনে কখনও কখনও স্তম্ভিত হয়েছি


জনপ্রতিধিদের নিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে, তাদের একটি অংশ এসেছে ছাত্ররাজনীতি থেকে, একটি অংশ নীতিহীন বুদ্ধিজীবী মহল থেকে, একটি অংশ মতলববাজ উচ্ছিষ্টভোগী ধর্মব্যবসায়ীদের থেকে, একটি অংশ অনৈতিক ব্যবসায়ী থেকে, কেউ প্রবেশ করেছে ব্লাডি সিভিলিয়ানকে সামরিক গণতন্ত্র শেখানোর জন্য অস্ত্র হাতে। আবার কেউ কেউ মহলবিশেষের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে অথবা জনমতের সমর্থনেই জনপ্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। দেশকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালনার জন্যই জনপ্রতিনিধিদের প্রয়োজন। জনপ্রতিনিধিত্ব সফল করতে দরকার নানা ধরনের, নানা পর্যায়ের কর্মী।
নেতৃত্বের প্রসঙ্গটি নানাভাবে পর্যবেক্ষণ এবং দলের প্রধানের অবস্থান বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, গ্রাম থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত নানা ধরনের এবং নানা পদের দলীয় লোক ও দলের সমর্থক কাজ করছে। মানুষ অবশ্য নিজের অবস্থান থেকে একটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক দলের সমর্থক হয়ে বা নেতৃত্ব থেকে নিজের অস্তিত্বকে প্রকাশ করে। মানুষ রাজনীতি ছাড়াও ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক বা অন্যান্য পেশার লোকজনের সঙ্গেও বিনি সুতার মালার মতো একতাবদ্ধ থাকে।
যারা রাজনীতি করেন তারা ছোটবেলা থেকেই নিজের সুপ্ত আশাকে প্রতিফলিত করার জন্য পথপরিক্রমার মাধ্যমে নেতৃত্বের স্বপ্নকেই সঙ্গে নিয়ে চলেন। নেতৃত্বের নানা বাধা অতিক্রম করে অভীষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছার জন্য শিক্ষানবিশ হিসেবে নেতাকর্মীদের বিশ্বস্ততা অর্জন করে রাজনীতিতে চলার পথ তৈরি করেন।
নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়ায় একদিকে যেমন বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, অন্যদিকে তিক্ত অভিজ্ঞতারও মুখোমুখি হতে হয়েছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আমাকে বহনকারী জিপ গাড়িটি সহযাত্রীসহ পুকুরের পানিতে ডুবে গিয়েছিল। অল্পের জন্য সেদিন আমি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম। দীর্ঘদিন নির্বাচনী প্রচারণার সময়ে আমার উপজেলার বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার ফলে নিজের নির্বাচনী এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার নানা কাহিনী, দুঃখ, বেদনা, অব্যক্ত কথা, অব্যক্ত মর্মবেদনা, না বলা রূঢ় বাস্তবতার নির্মম কাহিনী শুনে কখনও কখনও স্তম্ভিত হয়েছি।
প্রচারণার একপর্যায়ে একদিন রাতে রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার গুর্জ্জিপাড়া হাটে ভোট সংগ্রহের জন্য যাই। রাত সাড়ে ১০টার দিকে কয়েকজন কর্মীর পরামর্শে হাটের ছোট ছোট দোকানদারদের সঙ্গে সালাম বিনিময় ও হাত মেলানোর কাজ শুরু করি। সবাই কেনাবেচায় ব্যস্ত। এর মধ্যেই কুশল বিনিময় ও ভোটপ্রাপ্তির আবেদন। এভাবে সারা হাট ঘোরার পর হাটের এক কোনায় অবস্থিত মাছবাজারে যখন যাই, ঘড়িতে তখন রাত ১১টা। কেনাবেচার একেবারেই শেষ পর্যায়। বেশ কয়েকজন মাছ বিক্রেতার সঙ্গে কুশল বিনিময় শেষ হয়েছে। হঠাৎ দেখি দু'জন মাছ বিক্রেতা তাদের ডালায় রক্ষিত প্রায় ছয় ইঞ্চি লম্বা সিলভার কার্প মাছের পেটে টিপে মাছটা পচে গেছে না ভালো আছে তা পরখ করছে।
জিজ্ঞাসায় জেনেছি, ওই দোকানিদের একজনের নাম আবদুল, অন্যজনের নাম জিতেন্দ্র। দু'জনের মাছ পরখ করার দৃশ্যটি দেখে মনে মনে আঁতকে উঠেছি। আমি ওদের মাছ বিক্রির বাস্তব অবস্থা নিয়ে চিন্তার গভীরে পেঁৗছে গেছি। বড়জোর আধঘণ্টার মধ্যে হাট শেষ হবে। তারা তাদের ওই অবিক্রীত মাছ পচে গেছে না ভালো আছে সেটা নিয়েই যখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে, তখন অন্যদিকে বাস্তব অবস্থা হলো, মাছগুলো প্রাকৃতিক জলাশয় বা বিল থেকে ধরা নয়। মাছচাষিদের কাছ থেকেই মাছগুলো কিনেছে তারা। লাভ করা দূরে থাক মূলধন রক্ষা করাই তাদের দায়। ঠিক সে সময়ের রূঢ় বাস্তবতা হলো, ক্ষুধার্ত স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা প্রয়োজনীয় চাল-ডাল কিনে তাদের ঘরে ফেরার প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষারত।
নির্বাচনী প্রচারণার শেষ পর্যায়ে পীরগঞ্জের একটি গ্রামে গিয়েছিলাম। গ্রামটি গাইবান্ধা জেলার সাদুল্যাপুর উপজেলার ভেতরেই একটি ছিটমহলের মতো। রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের ধাপেরহাটের কাছে গ্রামটির অবস্থান। ছোট্ট গ্রাম। কয়েক ঘর মধ্যবিত্ত এবং বেশিরভাগ নিম্নবিত্ত মানুষের বসবাস এই রসুলপুর নামের গ্রামে। দেশের হাজার হাজার গ্রামে যেমন সব ধর্মের লোকের সহাবস্থান, এই গ্রামটিতেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। মুসলমান ও হিন্দু উভয় ধর্মের লোকের অবস্থান গ্রামটিতে।
উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত গ্রামটি। বড় রাস্তা থেকে পূর্বদিকের রাস্তা ধরে হাঁটলে সরাসরি মসজিদ ঘরটির কাছ পর্যন্ত যাওয়া যায়। মসজিদের চারদিকে ইটের দেয়াল, ওপরে টিনের চালা। নির্বাচনী প্রচারণার একেবারেই শেষদিকে রাত ১১টায় মসজিদের আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কুশল বিনিময় করি। প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাইলে তারা দুঃখ করে বলেছিল, আমরা বরাবরই নৌকায় ভোট দিই। কিন্তু স্বাধীনতার পর কোনো নেতাকর্মী আমাদের কাছে ভোট চাইতে আসেননি। গ্রাম যাদের লেখাপড়া শিখিয়ে ডাক্তার-ব্যারিস্টার তৈরি করেছে, তারা এখন বড় বড় শহরে বাস করেন। আবার কেউ কেউ বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য পাড়ি জমান। শিক্ষিত লোক গ্রামে থেকে শহরে চলে যাওয়ার এ ধারা অব্যাহত থাকলে গ্রামগুলো আস্তে আস্তে অশিক্ষিত, টাউট-বাটপার এবং মিথ্যাবাদী লোকে ভরে যাবে।
গ্রামটির উত্তর দিকের দরিদ্র হিন্দু জেলেপাড়ায় যখন যাই রাত তখন সাড়ে ১১টা। পাড়ায় ঢুকেই তাদের পাড়ায় মন্দির আছে কি-না জিজ্ঞেস করেছি। আমার উদ্দেশ্য ছিল মন্দিরের কাছে সবাইকে নিয়ে ভোট চাওয়া। উদ্দেশ্য মতো আমাকে নেওয়া হলো তাদের মন্দিরের কাছে। মন্দিরটির চারদিকে ছোট ছোট কুঁড়েঘরে জেলেদের বসবাস। একদিকের কোনায় মন্দিরটির অবস্থান। খড়ের চালের ছোট্ট একটা ঘরেই বসানো হয়েছে তাদের ঠাকুর দেবতাকে। ঘরটিতে দরজা-জানালার বালাই নেই। মন্দিরের ঘরটি এবং রক্ষিত ঠাকুর দেবতাকে দেখলেই এর চারপাশের বাসিন্দাদের আর্থিক অবস্থা সহজে উপলব্ধি করা যায়। সেখানে অধিকাংশ মহিলা তখনও জেগে আছেন। মন্দিরের পাশে অনেকেই সমবেত।
উপস্থিত লোকজনের মধ্যে মহিলার সংখ্যাই বেশি। মন্দিরের সামনে দাঁড়ানো এক গৃহবধূকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তার নাম কী? উত্তরে বলেছিলেন শ্রীমতী। কৌতূহলে জিজ্ঞেস করেছি, তার রাতের খাবার তিনি রেঁধেছেন কি-না। শীর্ণকায় শরীর, বেশ চটপটে বউটি। হাসিমুখে বলেছিলেন, তার রাতের খাবার তিনি রেঁধেছেন। জিজ্ঞেস করেছিলাম, তার পরিবারের সদস্যসংখ্যা কত। বলেছিলেন_ শাশুড়ি, দুই বছরের মেয়ে এবং তারা স্বামী-স্ত্রী। এবার উপস্থিত মহিলাদের মধ্যে প্রায় জনাবিশেককে জিজ্ঞেস করেছিলাম তারা রাতের খাবার রেঁধেছেন কি-না। পিলে চমকে দেওয়ার মতো উত্তর দিয়েছেন_ না, তারা কেউ রাঁধেননি। ছোট মেয়েমেয়েরা অনেকেই অভুক্ত অবস্থায় শুধু পানি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
কেন তারা রাঁধেননি? বারবার জিজ্ঞেস করেও কোনো সদুত্তর না পেয়ে আবার শ্রীমতীকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাকিরা তাদের খাবার রাঁধেননি কেন? এবার শ্রীমতী অবনতমস্তকে দুঃখভারাক্রান্ত মনে বিনীতভাবে খুব আস্তে আস্তে বলেছিলেন, আমাদের এ পাড়ার সবাই গরিব জেলে। পশ্চিম দিকের বড় রাস্তার ধারে নদীতে আমাদের পাড়ার লোকেরা মাছ ধরত। নদী এখন শুকনো। বর্ষায়ও আগের মতো আর তেমন মাছ পাওয়া যায় না। গ্রামের পাশের একসময় মাছে পরিপূর্ণ খাটমারা বিলটি বড়লোকেরা লিজ নিয়ে ভরাট করে ধান চাষ করে। আর গ্রামের পূর্বদিকের বিলটি এখন এলাকার মতলববাজ লোকরা লিজ নিয়েছে। সেখানে তারা আমাদের জেলেদের মাছ ধরতে দেয় না। বিভিন্ন পুকুরে চাষ করা মাছ কেনাবেচা করেই আমাদের পাড়ার জেলেরা সংসার চালায়। হাট শেষে তাদের ব্যবসার লভ্যাংশ দিয়েই চাল, ডাল, সবজি কিনে বাড়িতে ফিরবে। হাট বেশ দূরে হওয়ায় এখনও কেউ পাড়ায় ফেরেনি। তারা ফিরলেই সবার হাঁড়িতে চাল, ডাল, সবজি সিদ্ধ হবে। এর পরই হবে তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে খাওয়াদাওয়া। অত্যন্ত সত্য এবং বাস্তবতার নির্মম অবস্থাটির বর্ণনা শুনে গভীর দুঃখবোধে ভারাক্রান্ত হয়েছি। সে দিনের মতো প্রচারণার কাজ শেষ করে বাড়িতে ফেরার পথে মনে মনে ভেবেছি, যেসব পরিবারে এক সন্ধ্যা খাবারের সঞ্চয় থাকে না, আবদুল আর জিতেন্দ্রদের মতো জেলেদের মাঝরাতে অবিক্রীত মাছের পেট টিপে পচে গেছে কি-না পরখ করতে হয়, বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে পুরো পরিবার তীব্র ক্ষুধায় চাল, ডাল, সবজি নিয়ে জেলেদের ঘরে ফেরার অপেক্ষায় থাকে; বারবার মনে প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে, শতমুখী অভাবের এই দরিদ্র মানুষগুলোর সমস্যার সমাধান কীভাবে সম্ভব হবে?

আবুল কালাম আজাদ : সংসদ সদস্য

পায়ের কোথায় যেন জুতার পেরেক খোঁচাচ্ছে... - অজয় দাশগুপ্ত - সমকাল

ঘাতকের হাতে নিহত জাতির জনকের আত্মার মাগফিরাত কামনা করাও ছিল সামরিক শাসকদের দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধ। এটাও বলা দরকার যে ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবল্পুব্দর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে দেশের কোনো সংবাদপত্রে এ সংক্রান্ত একটি লাইনও প্রকাশিত হয়নি। পরের দিনেও ছিল না দিবসটি পালনের কোনো সংবাদ। দেশে গণতন্ত্র কায়েমের জন্যই নাকি বঙ্গবল্পুব্দকে হত্যা করা হয়েছিল!


তিন যুগ_ ৩৬ বছর আগের কথা। ১৯৭৫ সালের প্রত্যুষে বঙ্গবল্পুব্দ নিহত হয়েছিলেন। এর এক বছর পর ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালনের জন্য ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মসূচি ছিল নিম্নরূপ : ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবল্পুব্দর বাসভবনে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে মিলাদ মাহফিল। তখনও সামরিক শাসন চলছিল। রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম দায়িত্ব পালন করছেন। তবে সবাই জানত যে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। সরকারে তার দায়িত্ব অর্থ, তথ্যসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার পদ। আর সামরিক আইন বলবতে তিনি রয়েছেন উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে। নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানদ্বয়ও দায়িত্ব পালন করছেন উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের আগের সন্ধ্যায় বিচারপতি সায়েম এবং তিনজন উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের মধ্যে একজন জিয়াউর রহমান জাতির উদ্দেশে ভাষণ প্রদান করেন। তবে এ ভাষণে তাদের একজনও বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উচ্চারণ করেননি, শ্রদ্ধা নিবেদন তো দূরের কথা। সে সময়ের সংবাদপত্র এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত বেতার ও টেলিভিশনে স্বাধীনতার স্থপতি ছিলেন নিষিদ্ধ একটি নাম। তবে তাকে অপবাদ দিতে সক্রিয় ছিল চেনা একটি মহল। সরকারের উদ্যোগে কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমেও বঙ্গবল্পুব্দ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে কুৎসা রটিয়ে প্রচার করা হতো এবং তা দেশের সংবাদপত্র-বেতার-টিভিতে ফলাও করে প্রচারের ব্যবস্থা করত সামরিক সরকার।
বঙ্গবল্পুব্দ হত্যার প্রথম র্বাির্ষকীর কয়েক দিন আগে ২৭ জুলাই (১৯৭৬) বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের নেতাদের সভায় ৩০ জুলাই থেকে ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। সামরিক ফরমান দিয়ে জানানো হয়, যারা রাজনৈতিক দল করতে চায় তাদের সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। দলের ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচি এবং গঠনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য দলগুলো চার দেয়ালের মধ্যে বৈঠক করতে পারবে এবং এ সংক্রান্ত খবর সংবাদপত্রও প্রচার করতে পারবে। তবে সে সময়ে সংবাদপত্রে ছিল কড়া সেন্সরশিপ। সরকারের ইচ্ছার বাইরে কিছু প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না। গণতন্ত্রের কী অপার মহিমা!
১৫ আগস্ট ঘাতকদের একাধিক সূত্র এবং ওই ভয়ঙ্কর সময়ে সেখানে উপস্থিত কেউ কেউ জানিয়েছেন, ঘাতকদের উদ্দেশে বঙ্গবল্পুব্দ বলেছিলেন, 'তাকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতন্ত্রকেও হত্যা করা হবে।' এ কথা বলার পরপরই ঘাতকের ব্রাশফায়ারে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
বঙ্গবল্পুব্দর শেষ কথাটি কতই না প্রফেটিক ছিল!
১৫ আগস্টের প্রথম বার্ষিকী পালন করতে গিয়ে আবারও তার প্রমাণ মিলেছিল। ঘরোয়া রাজনীতি চালু হওয়ায় বঙ্গবল্পুব্দর বাসভবনে ফুল দিয়ে শ্রদব্দা নিবেদনের মতো সাধারণ কর্মসূচি পালনে সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাধা সৃষ্টি করবে না, এমন ধারণা করেছিলেন উদ্যোক্তা ছাত্র নেতৃবৃন্দ। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের সামরিক শাসকদের চিনতে তাদের অনেক বাকি ছিল! ১৫ আগস্ট ভোরে নাজনীন সুলতানা (বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী অফিসার) এবং নিনু নাজমুন আরা নামে দু'জন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা বঙ্গবল্পুব্দর বাসভবনের গেটে ফুল রেখে প্রথম শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তাদের বাসার ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। পরে ছাত্রছাত্রীদের ছোট ছোট গ্রুপ ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের পথে রওনা দেয়। কিন্তু ততক্ষণে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দারা বঙ্গবল্পুব্দর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের কর্মসূচির খবর জেনে গেছে। তারা আর কাউকে বাসভবনের গেটের কাছে তো দূরের কথা, ৩২ নম্বরেও প্রবেশ করতে দেয়নি। অনেককে মারধর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।
দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে মিলাদ অনুষ্ঠানকে ঘিরে রেখেছিল পুলিশের একটি বড় দল। তারা মিলাদে অংশ নিতে আসা ছাত্রদের নানাভাবে হয়রানি করে। ঘাতকের হাতে নিহত জাতির জনকের আত্মার মাগফিরাত কামনা করাও ছিল সামরিক শাসকদের দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধ। এটাও বলা দরকার যে ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবল্পুব্দর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে দেশের কোনো সংবাদপত্রে এ সংক্রান্ত একটি লাইনও প্রকাশিত হয়নি। পরের দিনেও ছিল না দিবসটি পালনের কোনো সংবাদ। দেশে গণতন্ত্র কায়েমের জন্যই নাকি বঙ্গবল্পুব্দকে হত্যা করা হয়েছিল!
২৭ জুলাই (১৯৭৬) বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের বৈঠকে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মোজাফফর) এবং সিপিবি_ এ তিনটি দলের নেতাদের কেন আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কয়েকটি দলের নেতারা। জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, ইউপিপি (কাজী জাফর আহমদ) প্রভৃতি দলের নেতারা সামরিক শাসকদের কাছে দাবি করেন যে শেখ মুজিবের অনুগামীদের কোনোভাবেই যেন রাজনীতি করার অধিকার প্রদান করা না হয়।
বঙ্গবল্পুব্দ একজন নন-এনটিটি বা কোনো কালে এমন কেউ ছিলেন না, এটাই চেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান এবং তার ঘনিষ্ঠজনরা। ১৯৭৬ সালের ৪ আগস্ট সামরিক সরকার এক নতুন বিধি ইস্যু করে জানিয়ে দেয় :'জীবিত বা মৃত কোনো ব্যক্তিকে কেন্দ্র করিয়া কোনো প্রকার ব্যক্তি পূজার উদ্রেক বা ব্যক্তিত্বের মাহাত্ম্য প্রচার ও বিকাশ' সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে। জিয়াউর রহমান-পরবর্তী সামরিক শাসক এইচএম এরশাদের আমলেও বঙ্গবল্পুব্দ ছিলেন বাংলাদেশের শাসকদের কাছে নিষিদ্ধ।
কেন এমনটি তারা চেয়েছিলেন, সেটা স্পষ্ট। বঙ্গবল্পুব্দ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি ছিলেন। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কথা তিনি সব সময় বলতেন। দেশের সমস্যাগুলোর ব্যাপারে তার পর্যবেক্ষণ ছিল অনুপুঙ্খ, অন্তর্দৃষ্টি ছিল গভীর। যারা বাংলাদেশ চায়নি একাত্তরে, তারা বঙ্গবল্পুব্দকেই স্বাধীন দেশের পথের কাঁটা মনে করেছে। তাকে নির্মমভাবে হত্যা করার পরও নব্য শাসকদের স্বস্তি ছিল না। স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি যেন রাজনীতির অঙ্গনে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেজন্য তারা দমননীতি ও অপপ্রচারসহ সব ধরনের কূটকৌশল অবলম্বন করেছে। গ্রেফতার করা হয়েছে শত শত নেতাকর্মীকে। মানবাধিকার বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব সামরিক শাসকদের কাছে ছিল না। জিয়াউর রহমান প্রথমদিকে বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে শিখণ্ডীর মতো সামনে রেখে ক্ষমতার দণ্ড পরিচালনা করেন। ১৯৭৬ সালের নভেম্বরে তিনি প্রধান সামরিক শাসকের পদ গ্রহণ করেন এবং কিছুদিন পর রাষ্ট্রপতি পদ থেকে বিচারপতি সায়েম সাহেবকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই সে পদ গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালের জুন মাসে সামরিক শাসন বজায় রেখেই দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে 'এক কোটিরও বেশি ভোটের ব্যবধানে'। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ও ছিল দেশে সামরিক শাসন এবং এ সংসদই কুখ্যাত পঞ্চম সংশোধনী অনুমোদন করে, যা সম্প্রতি সর্বোচ্চ আদালতে অবৈধ ঘোষিত হয়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবল্পুব্দকে হত্যার সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা ছিল যথেষ্ট। এ ঘটনার মাত্র দুই মাস নয় দিন আগে (৬ জুন রাতে) একক রাজনৈতিক দল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল) এবং তার বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। এসব কমিটিতে অন্য কয়েকটি দলের কিছু প্রতিনিধি রাখা হলেও বিপুল প্রাধান্য ছিল আওয়ামী লীগ এবং তার বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের। জেলা ও থানা কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছিল এবং দেশের সর্বত্র আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অনেকেই নিজেদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করায় তৎপর ছিল। এ সুযোগে যে ঘরের শত্রু বিভীষণরূপী খন্দকার মোশতাক আহমদকে সামনে রেখে ঘাতক চক্র শক্তি সঞ্চয় করে, সেটা তারা বোঝার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেনি। এ কারণেই ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের পক্ষে গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে কিছুটা সময় লাগে।
বর্তমানে এ দলটি অনেক সংহত। কিন্তু পঁচাত্তরের ঘটনাপ্রবাহের একজন নিবিড় পর্যবেক্ষক হিসেবে সে সময়ের সঙ্গে যেন কিছুটা সামঞ্জস্যও খুঁজে পাই। তখন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের অনেকের ব্যস্ততা ছিল নিজেদের নিয়ে। এখনও তেমন লক্ষণই প্রকট। দল ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর সাংগঠনিক কার্যক্রম সীমিত, সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বিভিন্ন প্রকল্প এবং সরকারি-আধা সরকারি নানা প্রতিষ্ঠান থেকে সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ অনেকের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগ এখন যা করছে, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়েও এ ধরনের অভিযোগই ছিল তাদের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার পর এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছিলেন শফিউল আলম প্রধান, যার নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্য সাতজন ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা হয়। শেখ হাসিনার সামনে এখন যেসব এজেন্ডা তা বাস্তবায়নে সরকার ও দলের পক্ষে জনসমর্থন আদায়ে আরও বেশি সক্রিয়তা আওয়ামী লীগ এবং তাদের সমর্থক বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, গণতান্ত্রিক পন্থা ব্যতিরেকে অন্য উপায়ে ক্ষমতা দখলকে চিরকালের জন্য অবৈধ ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্থায়ী রূপ দেওয়া, ধর্মান্ধ জঙ্গি শক্তিকে দমন প্রভৃতি প্রতিটি পদক্ষেপে প্রবল প্রতিরোধ আসা স্বাভাবিক এবং সেটা আসছেও। ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে সক্রিয় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা কি বুঝতে পারছে না যে এখনও 'পায়ে জুতার কোন পেরেক খোঁচাচ্ছে?' এটা চিহ্নিত করতে না পারলে কিন্তু পুরো পেরেক পায়ে ঢুকে যেতে পারে এবং তা ডেকে আনতে পারে প্রাণঘাতী ধনুষ্টঙ্কার ব্যাধি।
লেখাটি শেষ করব ১৯৭৬ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে কাজল ব্যানার্জি (এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক) সম্পাদিত 'দেখা পেলেম ফাল্গুনে' সংকলনে মৃণাল সরকারের 'সরকার মুজিব বিন' ছদ্মনামে লেখা কবিতার অংশবিশেষ উল্লেখ করে : এই সেদিনও তো রাজ্য ছিল/ সোনার সংসার ছিল/ পাণ্ডবেরা রাজা ছিল/ হায়! যুধিষ্ঠির চলে গেলে/ ছারখারে ছাই হয় সোনার সংসার।
ছাই হওয়া সোনার সংসার ফিরিয়ে আনার কাজ কিন্তু মোটেই সহজ নয়।

অজয় দাশগুপ্ত :সাংবাদিক

হীরক রাজার দেশে ‘মূর্খতার মচ্ছব’ মতিয়া চৌধুরীর মহা মহা আবিষ্কার আ ব দু ল হা ই শি ক দা র - আমার দেশ

প্রাক্তন ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের মনের মধ্যে কী ছিল জানি না। কিন্তু তাদের আয়োজিত ‘পঞ্চদশ সংশোধনী ও বর্তমান রাজনীতি’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, এই পঞ্চদশ সংশোধনী বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর ‘মুদ্রিত মূর্খতা’। বলেছেন, ‘এটি শাসক শ্রেণীর বিবেক প্রতিবন্ধিতা, আপসকামিতা ও মোনাফেকির দলিল।’ এ জন্যই বোধকরি তারা বলেছেন, ‘এটিকে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া যাবে না। বরং ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে অতীতের শাসক শ্রেণীর নির্বুদ্ধিতার প্রমাণ দেখাতেই এটিকে তুলে রাখতে হবে। দলীয় ও ব্যক্তিগত স্বার্থে, গায়ের জোরে পঞ্চদশ সংশোধনী করা হয়েছে।’
এই সংগঠন ও বক্তারা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কিংবা মুফতি ফজলুল হক আমিনীর মতো ভয়ানক বিষাক্ত বাক্যবাণ বা মামলা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন কি না জানি না। হলেও অবাক হতাম না। কারণ পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের পর একদিকে বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতার দরোজা রুদ্ধ হয়েছে, অন্যদিকে শাসক দল, বিশেষ করে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা হয়ে পড়েছেন ভয়াবহ রকম মারমুখী। অস্থির, অসহিষ্ণু এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ।
চোখের সামনের ভদ্রতার পর্দা বলে এখন আর কিছু নেই। লাগামমুক্ত কণ্ঠস্বর সপ্তমে চড়িয়ে, যার যা খুশি তারা বলে যাচ্ছেন। যে যেভাবে পারেন মুখ ও জিহ্বার ঝাল মেটাচ্ছেন; ধার পরীক্ষা করছেন। এত যে বৃষ্টি হচ্ছে তবুও বর্তমান সরকার ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের মাথা কিছুতেই ঠাণ্ডা হচ্ছে না। থামছে না অতিকথন। যেন চলছে গালাগাল আর মূর্খতার প্রদর্শনী। দেশে যেন হচ্ছে মচ্ছব। মূর্খতার মচ্ছব।
সে জন্যই যে যাই বলুক, কুচ পরোয়া নেই। চোয়ালবাজি বিরতিহীনভাবেই চলছে। এক মন্ত্রী বলছেন, একদিন বাজারে যাবেন না। সঙ্গে সঙ্গে বাঁচাল বাণিজ্যমন্ত্রী আবিষ্কার করলেন ‘কম খান’ তত্ত্ব। ব্যর্থ, অথর্ব অর্থমন্ত্রী শেয়ারবাজারের নিঃস্ব-রিক্ত ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীকে ফট করে বলে বসলেন ফটকাবাজ।
আমার খুব ইচ্ছে করছিল আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী যে দারুণ একটা তত্ত্ব জাতিকে উপহার দিয়েছেন সে জন্য তাকে পিঠে চাপড়ে দেব। কিন্তু বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং ওবায়দুল কাদের সাহেবের ‘কথা কম কাজ বেশি’ কিংবা ‘জাতির সঙ্গে তামাশা বন্ধ করুন’ শুনে মন খারাপ করে ফেলেছি।
প্রাচীন পণ্ডিতরা বলতেন, আমরা সত্যি হতভাগা। আমরা গুণের কদর করতে জানি না। গুণীজনকে সম্মান দিতে পারি না। সেই কথাই আবার সত্য হলো। নইলে ফারুক খানের এই আবিষ্কারের জন্য তার মতবাদ মার্কসবাদ, লেলিনবাদ, কিংবা মাও সে তুংয়ের চিন্তাধারার মতো সাদরে গৃহীত হতো।
কত কষ্ট করে দেশ ও জাতির জন্য দিন-রাত খেটেখুটে, আহার নিদ্রা হারাম করে মাননীয় বাণিজ্যমন্ত্রী আর্কিমেডিসের মতো ইউরেকা ইউরেকা বলে আবিষ্কার করলেন এই ‘কম খান তত্ত্ব’। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মতো, টমাস আলভা এডিসনের মতো, রাইট ব্রাদার্সের মতো ফারুখ খানের এই আবিষ্কার পুষ্পচন্দন ধূপ ধুনা দিয়ে বরণ করার বদলে তার একটা স্টাচু রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে স্থাপনের বদলে আমরা সবাই মিলে তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে এত বড় একটা আবিষ্কারের মহিমাকে ধুলায় মিলিয়ে দিচ্ছি।
বলা হচ্ছে এরপর তিনি হয়তো বলবেন, কম কাপড় পড়ুন, উলঙ্গ থাকুন। কত বড় অন্যায়!
দুই.
ফারুক খানকে একটা গণসংবর্ধনা দেয়ার ইচ্ছে থাকলেও এখন আরেক আবিষ্কারের সামনে জাতি বিস্মিত, বাকরুদ্ধ। এত আনন্দ সহ্য করা যায় না। আসলে আমাদের বর্তমান সরকারের মধ্যে প্রতিভার ছড়াছড়ি। আর আমরা হলাম ভৌগোলিকভাবে ভাঙনপ্রবণ মৃত্তিকার মানুষ। বন্যার পর আসে ঝড়। ঝড়ের পরে আসে গোর্কি। একটা নিয়ে হৈচৈ শুরু করার আগেই শুরু হয়ে যায় আরেকটি। ফলে আবিষ্কারের পর আবিষ্কারের ধাক্কায় আমাদের জীবন হয়ে পড়েছে টলমল। কোনটা রেখে কোনটা নিয়ে কথা বলি!
ফারুক খান, আবুল মাল আবদুল মুহিত ও কামরুল ইসলামকে টেক্কা দিয়ে আবার আবিষ্কারের প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। মতিয়া আপার দ্বিতীয় মহা মহা আবিষ্কার প্রথমবারের মতো অবমুক্ত হয়েছে গত ১০ আগস্ট, স্বাধীনতা চিকিত্সা পরিষদের এক সমাবেশে। তিনি তার আবিষ্কার উপস্থাপন করে বলেন, ‘জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ২২ হাজার রাজাকারকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। তারপর রাজাকারদের পুনর্বাসনের জন্য সব ব্যবস্থা করেন।’
তিনি অত্যন্ত জোর দিয়ে তার আবিষ্কারের পক্ষে যুক্তি উত্থাপন করে বলেন, বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের কখনোই ক্ষমা করেননি। তাদের ক্ষমা করেছেন জিয়াউর রহমান।
মতিয়া আপার এই আবিষ্কারে নিশ্চয়ই সরকারি মহলে ধন্য ধন্য পড়ে গেছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ‘জিয়া উচ্ছেদ প্রকল্পে’ এই আবিষ্কার নতুন প্রাণশক্তি জোগান দেবে সন্দেহ নেই।
এর আগেও মতিয়া আপা আবিষ্কার করেছিলেন, জিয়া মুক্তিযুদ্ধ করলেও মন থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেননি। তার বক্তব্য পড়ে চারদিকে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। আমরাও তখন বলেছি, সত্যি এটা একটা দারুণ আবিষ্কার। এই আবিষ্কারের ভেতর দিয়ে প্রমাণিত হলো, মতিয়া আপার ‘রুহানি ফয়েজ’ হাসিল হয়েছে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার দেখাই হয়নি। জিয়া যখন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করছেন, তখন মতিয়া আপা কোথায় ছিলেন আল্লাহ পাক জানেন, আমরা জানি না। জিয়ার নেতৃত্বে কোদাল হাতে সিপিবি ও ন্যাপসহ সবাই যখন দেশ গঠনে খাল কাটা কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিল, তখন মতিয়া আপা কোদাল ধরেছিলেন কি না আমরা জানি না, আল্লাহ জানেন। তারপর জিয়ার শাহাদাত প্রাপ্তির ৩০ বছর পর অনুকূল বাতাসে মোড়ক খুলে গেল তার আবিষ্কারের।
রুহানি ফয়েজ হাসিল ছাড়া দূরের একজন মানুষের মনের খবর জানার আর কোনো পথ নেই। তেমন যন্ত্র আজও কোথাও পাওয়া যায়নি। ফলে সঙ্গত কারণেই আমার মতো অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, হজরত রাবেয়া বসরির পর আর একজন মহিলা আউলিয়া পাওয়া গেল। যিনি যে কারও মনের কথা বলে দিতে পারেন। এমনকি মৃত মানুষের মনের খবরও তার অজানা নয়। কী হতে পারে তার সম্ভাব্য নাম, ‘মতিয়া বসরী’ নাকি ‘মতিয়া শেরপুরী’?
বিষয়টিকে হাল্কা করে দেখার উপায় নেই। রীতিমত ভারী। তখনই আমাদের মনে হয়েছিল এই যে রুহানি শক্তি, তা পারমাণবিক শক্তির মতোই জাতির বৃহত্তর কল্যাণে লাগানো যেতে পারে। তাকে উত্সাহ দিলে তিনি আরও অনেক নতুন নতুন বাণী জাতিকে শোনাতে পারবেন। প্রথম আবিস্কারে হয়তো বিপুল উত্সাহ ও অনুপ্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন। সেই উত্সাহ ও অনুপ্রেরণার ফসলই হলো তার দ্বিতীয় আবিষ্কার। জিয়া ২২ হাজার রাজাকারকে ক্ষমা করেছিলেন। কারণ জিয়ার পিতা-মাতার কবর পাকিস্তানে। পাকিস্তানের কাছে তার ঋণ আছে।
এরপর হয়তো মতিয়া আপা বলবেন, পাকিস্তান যেহেতু পশ্চিম দিকে, অতএব পশ্চিম দিকে মুখ করে নামাজ পড়া যাবে না। কারণ তার মধ্যে পাকিস্তান প্রীতি প্রকাশ পেতে পারে।
তিন.
যার পিতা-মাতার কবর পাকিস্তানে নয়, গোপালগঞ্জের টুঙ্গী পাড়ায়, সেই মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা প্রসঙ্গে ‘ইতিহাসের রক্ত পলাশ; পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর’ গ্রন্থে আওয়ামী বুদ্ধিজীবীকুল শিরোমণি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন, ‘১৯৭৩ সালে ডিসেম্বর মাসে বিজয় দিবসের আগে বঙ্গবন্ধু আমাকে কলকাতা থেকে ডেকে পাঠান।... তিনি আমাকে একান্তে ডেকে নিলেন। বললেন, এখনই একটি সরকারি ঘোষণার খসড়া তোমাকে লিখতে হবে। পাকিস্তানিদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যারা দণ্ডিত ও অভিযুক্ত হয়েছেন, সবার জন্য ঢালাও ক্ষমা (জেনারেল অ্যামনেস্টি) ঘোষণা করতে যাচ্ছি। বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলাম, পালের গোদাদের ছেড়ে দেবেন।... মুজিব হেসে বললেন, না, তা হয় না। সবাইকেই ছেড়ে দিতে হবে। আমার এ আসনে বসলে তোমাকেও তাই করতে হতো।’ যথারীতি এ লেখার মধ্যেও সাল-তারিখ নিয়ে মিথ্যাচার করেছেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী।
শেখ মুজিব ‘১৯৭২ সালের বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনালস) আদেশ (পিও নং ৮, ১৯৭২ সালে) বলে আটক ও সাজা ভোগ করছিলেন যারা তাদের সবাইকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন ১৯৭২ সালের ৩০ নভেম্বর। অর্থাত্ সব রাজাকারকে ক্ষমা করে দেন মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান। আর যুদ্ধাপরাধীদের তিনি ক্ষমা করেন ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল।
দালাল আইন করলেন শেখ মুজিব। দালাল আইন বাতিল করে রাজাকারদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন শেখ মুজিব। যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করলেন শেখ মুজিব। তারপরও ইতিহাসের এত বড় সত্যকে পায়ের নিচে চাপা দিয়ে মতিয়া আপা তারস্বরে চিত্কার করে বলছেন, জিয়া ২২ হাজার রাজাকারকে ক্ষমা করেছিলেন।
চার
মতিয়া আপাসহ সব মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীকে টেক্কা দিয়েছেন ফখরুদ্দীন ও মইনউদ্দিনের পেয়ারের প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ, টি, এম শামসুল হুদা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে চলমান সংলাপ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, আমাদের সংলাপ হলো একটা কার্টেসি।
অর্থাত্ লোক দেখানো সৌজন্য মাত্র। কারণ তার ভাষায় ‘আমরা যাহা ইচ্ছা তাহাই করিতে পারি।’
তার কথা শুনে গুপী গাইন বাঘা বাইনের মতো বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, ‘দেখোরে নয়ন মেলে, দেখোরে জগতের কী বাহার।’ কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়।
পাঁচ.
বাংলাদেশ যেন কয়েক বছরের মধ্যে সত্যজিত্ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ পরিণত হয়েছে। অথবা হীরক রাজার দেশের দ্বিতীয় পর্বের অভিনয় চলছে এখন।
হীরক রাজা যা বলবে তাতেই সবাইকে ধন্য ধন্য করতে হবে। নইলে যন্ত্রর মন্ত্রর ঘরে ঢুকিয়ে মগজ ধোলাই করে দেয়া হবে। বলতে হবে, ‘যায় যদি যাক প্রাণ, হীরকের রাজা ভগবান।’ কৃষক বলবে, ‘ভরপেট না-ও খাই, রাজ কর দেওয়া চাই।’ শ্রমিককে বলতে হবে, ‘অনাহারে নাহি খেদ, বেশি খেলে বাড়ে মেদ।’
স্কুল পাঠশালা বন্ধ করে বলতে হবে, ‘লেখাপড়া করে যেই, অনাহারে মরে সেই।’ ‘বিদ্যালাভে লোকসান, নাই অর্থ নাই মান।’ ‘জানার কোন শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই।’
হীরকের এই অদ্ভুতুড়ে দুঃশাসনের সহায়ক তার মন্ত্রী, বৈজ্ঞানিক, সভাকবি, জ্যোতিষী, তার মগজ ধোলাই হওয়া সৈন্যদল/তারপরও কি শেষ রক্ষা হলো, ‘যারা তার ধামাধারী, তাদেরও বিপদ ভারী।’
এক পণ্ডিত মশাই আর গুপী, বাঘা মিলে তচনচ করে হীরকের নির্যাতনের রাজত্ব। মগজ ধোলাই হওয়া কলের পুতুলের মতো সাধারণ মানুষের মধ্যে ফিরে এলো হুঁশ। তারা পথের দিশা পেয়ে ছুটল হীরকের বিশাল স্টাচু ভাঙতে। আর সেই দুষ্টু ছেলেটা, যে বাটুল দিয়ে ভেঙে দিয়েছিল রাজ মূর্তির নাক—সেও।
শেষ পর্যন্ত স্বয়ং হীরক রাজাও ছুটল তার মূর্তি ভাঙতে। মূর্তি উপড়ানোর জন্য লাগানো দড়ি ধরে সেও প্রাণপণ টানতে টানতে সবার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে গাইতে লাগল, ‘দড়ি ধরে মার টান, রাজা হবে খান খান।’
হীরক রাজার কাণ্ডজ্ঞান ফিরেছিল। কারণ সেখানে গুপী গাইন আর বাঘা বাইনের মতো ভালো মানুষরা এসে জুটেছিল। পেয়েছিল পণ্ডিত মশাইয়ের মতো নিবেদিতপ্রাণ জনসেবক, সমাজকর্মী। কিন্তু আমরা কোথায় যাব? কোথায় পাব গুপী গাইন বা বাঘা বাইনের মতো মানুষ। কোথায় পাব পণ্ডিত মশাইয়ের মতো দেশদরদী। আমাদের অচলায়তনের দ্বার ভাঙবে কে? কোথায় আমাদের অরিন্দম?
ছয়.
’৭১-এর কথা। পাক আর্মি ঢুকেছে একটি গ্রামে। দেখল একজনের উঠোনে বেশ কিছু মোরগ-মুরগি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর্মির কমান্ডার জিজ্ঞেস করল, এই মুরগা কা মালিক কৌন হ্যায়?
উপস্থিত লোকজনের মাঝ থেকে ভয়ে ভয়ে তিনজন এগিয়ে এলো, হুজুর আমরা হ্যায়।
তাদের ধারণা ছিল এরা হয়তো মোরগ-মুরগিগুলো চাইবে। ভেবেছিল চাওয়া মাত্র দিয়ে প্রাণ বাঁচাবে।
কমান্ডার প্রথম জনকে ডাকল, ‘এই তোম মোরগা কো কেয়া খাওয়াতা হ্যায়?
লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, ‘হুজুর ধান-চাল খাওয়াতা হ্যায়।’
রেগে আগুন হয়ে উঠল কমান্ডার, ‘কেয়া, পাবলিককো খানা তোম মুরগা কো খাওয়াতা হ্যায়। এই আদমি কো দশ লাথ মারো। লাথি খেয়ে সেতো পড়ি মরি চিত্কার।
এবার দ্বিতীয়জনকে কমান্ডার বলল, ‘এই তোম কেয়া খাওয়াতা হ্যায়?
ভয়ে নীল হয়ে যাওয়া লোকটা কাঁপতে কাঁপতে বলল, হুজুর আমি আটা খাওয়াতা হ্যায়! বলে হে হে করতে লাগল।
আবার রেগে আগুন কমান্ডার ‘এই শালে লোক, কেয়া বলতা হ্যায়? আর্মি কো খানা তোম মোরগা কো খাওয়াতা হ্যায়! এই লে যাও, এ শালাকে বিশ লাথি মারো।’
কমান্ডার এগিয়ে গেল সব শেষজনের দিকে, ‘এই তোম কেয়া খাওয়াতা হ্যায়?’
লোকটা নির্বিকারভাবে বলল, হুজুর হামি কিছুই খাওয়াতা হ্যায় না।
কেয়া?
হ হুজুর। প্রতিদিন সকালে আমি মোরগাকো ডাকতে হ্যায়। মোরগা মেরা পাঁচ আইতা হ্যায়। আইলে আমি প্রতি মোরগারে একটা করে টেকা দিতা হ্যায়। ওরা টেকা লাইয়া যাইয়া, যখন যা মন চায় কিনা কিনা খায়।
কমান্ডার খুব খুশি। বলল, তুম ভি সাচ্চা আদমি হো।

পুলিশ ও র‌্যাবের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সরকারও উদ্বিগ্ন পারভেজ খান ও এস এম আজাদ - কালের কন্ঠ

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশই ভঙ্গ করছে আইন। তারা একের পর এক ঘটাচ্ছে বিতর্কিত ঘটনা। বেড়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে অপরাধীদের সহায়তা, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া, মাদক ব্যবসায় মদদ দেওয়া, থানায় বন্দির ওপর নির্যাতন, গুম, গণপিটুনিতে সহায়তা করাসহ নানা অভিযোগ। তাদের আচরণে বিব্রত সরকারের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন মহল। গুটিকয়েক পুলিশ সদস্যের আচরণ জন্ম দিচ্ছে হাজারো প্রশ্ন। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে। আর তাই সরকারের এখন ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাদের বেকায়দায় ফেলার কোনো ষড়যন্ত্র চলছে কি না! এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার পুলিশের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছে। তারা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে থলের বেড়াল।
বিষয়টি নিয়ে বেকায়দায় রয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু পুলিশ নিয়ে বিতর্কের অভিযোগ স্বীকার করে বলেন, বিগত বিএনপি-জামায়াত সরকার নিজেদের স্বার্থে পুলিশকে ব্যবহার করায় পুলিশের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ে। বর্তমান সরকার এ থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করছে। আগামী ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে পুলিশ নিয়ে আর কোনো বিতর্ক থাকবে না জানিয়ে তিনি বলেন, 'দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনিতে নিহত হওয়ার ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গণমাধ্যমে যাদের নাম আসছে, তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গুরু পাপে লঘু নয়, গুরু পাপে গুরুদণ্ডই দেওয়া হবে।' গত বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে শোক দিবস উপলক্ষে ওলামা লীগ আয়োজিত এক আলোচনা সভা শেষে সাংবাদিকদের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
সম্প্রতি সাভারের আমিনবাজারে গণপিটুনিতে ছয় ছাত্র হত্যা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরের ওপর পুলিশি নির্যাতন, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে তরুণ মিলনকে গণপিটুনিতে হত্যা, রাজধানীর দয়াগঞ্জ থেকে তিন তরুণকে ডিবি পরিচয়ে অপহরণের পর হত্যা, সর্বশেষ বৃহস্পতিবার নওগাঁর ধামইরহাটে পুলিশের লাথিতে এক বৃদ্ধার মৃত্যুসহ কয়েকটি ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সমাজবিজ্ঞানী, অপরাধ বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকারকর্মী ও পুলিশের সাবেক কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিটি ঘটনারই বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত হওয়া দরকার। দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
বেড়েছে ন্যক্কারজনক আচরণ : সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ জুলাই খিলগাঁও থানার সিভিল টিমের এসআই আলম বাদশা ও এএসআই শাহিনুর রহমান সেগুনবাগিচা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যান। অভিযোগ উঠেছে, থানায় তাঁকে ডাকাতি মামলার আসামি সাজিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। খিলগাঁও থানার ওসি হেলাল উদ্দিনের নেতৃত্বে চালানো ওই নির্যাতনে হাত-পা থেঁতলে যায় কাদেরের। তাঁর পায়ে চাপাতি দিয়ে আঘাত করেন স্বয়ং থানার ওসি। আহত অবস্থায়ই তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। এ ঘটনা গণমাধ্যমে প্রচারিত হলে হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত (সুয়োমোটো) হয়ে আবদুল কাদেরকে আদালতে হাজির করেন। একই সঙ্গে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদেরও হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। পরে আদালত খিলগাঁও থানার ওসি হেলাল উদ্দিন, সিভিল টিমের কর্মকর্তা এসআই আলম বাদশা ও এএসআই শাহিনুর রহমানকে বরখাস্তের নির্দেশ দেন।
কাদেরের ঘটনার মতো দেশব্যাপী তোলপাড় হয়েছে গত ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামের আরেকটি ঘটনায়। অভিযোগ পাওয়া গেছে, এইচএসসি পরীক্ষার্থী লিমনকে র‌্যাব-৮-এর একটি দল আটক করে বাম পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় লিমনের একটি পা কেটে ফেলতে হয়। গত ১৮ জুলাই সাভারের আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামে ডাকাত সন্দেহে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। নিহত ছয় ছাত্রের বেঁচে যাওয়া সঙ্গী আল-আমিনের ভাষ্য, ঘটনার সময় সেখানে পুলিশ উপস্থিত ছিল। এই ঘটনার পর পুলিশের ভূমিকাকে কেন অবৈধ ও বে-আইনি ঘোষণা করা হবে না, তা সরকারের কাছে জানতে চান হাইকোর্ট। আরো অভিযোগ রয়েছে, বড়দেশীতে পুলিশকে ম্যানেজ করেই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে মাদক ব্যবসা।
সাভারের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত ২৭ জুলাই নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে নিরপরাধ কিশোর সামছুদ্দিন মিলনকে ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। তদন্তে বেরিয়ে আসে, খালাতো বোনের সঙ্গে দেখা করতে গেলে মিলনকে এলাকার কয়েকজন ধরে পুলিশে সোপর্দ করে। এরপর পুলিশ তাঁকে ডাকাত আখ্যায়িত করে গাড়ি থেকে নামিয়ে ছেড়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে। একটি টেলিভিশন চ্যানেল এ ঘটনার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করলে হৈচৈ পড়ে যায়। এ ঘটনায় ৬ আগস্ট এসআই আক্রাম উদ্দিন শেখ, কনস্টেবল হেমরঞ্জন চাকমা ও আবদুর রহিমকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ৮ আগস্ট কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি মো. রফিক উল্লাহকে ক্লোজ করা হয়।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার এক জরিপ থেকে জানা যায়, গত আড়াই বছরে দেশে গণপিটুনিতে ৩৬৩ জন নিহত হয়েছে। গত সাত মাসে ৮৮ জন প্রাণ হারিয়েছে। ডাকাতি সন্দেহে বেশির ভাগ ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
রহস্যজনক গুম-হত্যায় বিব্রত প্রশাসন : গত ৩১ জুলাই রাজধানীর দয়াগঞ্জ থেকে স্থানীয় তরুণ জুয়েল, রাজীব ও ওয়ার্কশপকর্মী মিজানুর হোসেনকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় কয়েকজন সাদা পোশাকের লোক। ৫ আগস্ট এই তিনজনের মধ্যে দুজনের লাশ পাওয়া যায় গাজীপুরে এবং আরেকজনের ঢাকা-মাওয়া সড়কের পাশে। এ ঘটনার কোনো দায়-দায়িত্ব স্বীকার করেনি ডিবি পুলিশ।
গত আড়াই বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে এমন বেশ কিছু অপহরণ ও হত্যার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনার কোনো তদন্তপ্রক্রিয়াই সঠিকভাবে এগোয় না। গত বছরের ১৭ এপ্রিল বাড্ডার কুড়িল থেকে র‌্যাব পরিচয়ধারীরা ঝালকাঠির রাজাপুরের মিজানুর রহমান মিজান, নাজমুল হক মুরাদ ও ফোরকানকে অপহরণ করে। ২৭ এপ্রিল মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানের পেছনে তুরাগ চরে ওই তিনজনের লাশ পাওয়া যায়। ১৮ এপ্রিল গাজীপুর থেকে পুলিশ নারায়ণগঞ্জের শীর্ষ সন্ত্রাসী নূরুল আমিন মাকসুদের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে। গত বছর কারওয়ান বাজারের শীর্ষ সন্ত্রাসী সাইদুলকে হত্যার পর লাশ গুম করে ফেলা হয়েছে বলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। বিএনপির নেতা ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর চৌধুরী আলমকে গত বছরের ২৫ জুন রাতে ফার্মগেট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে অভিযোগ করে তাঁর পরিবার। এখন পর্যন্ত তাঁর কোনো সন্ধান মেলেনি। রাজধানী থেকে নিখোঁজ হয় সাবেক যুবলীগ নেতা এবং তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী লিয়াকত হোসেন। তার স্ত্রী দাবি করেন, লিয়াকতকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই দাবি অস্বীকার করে র‌্যাব ও পুলিশ। যেটাই ঘটুক, লিয়াকত এখন পর্যন্ত নিখোঁজ। গত বছর ফার্মগেট এলাকা থেকে সুজন নামের এক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দাবি করে তাঁর পরিবার। ঘটনা অস্বীকার করেছে পুলিশ। সুজন নিখোঁজ আছেন এক বছর।
সমালোচনায় বেপরোয়া আচরণ : গত ২২ এপ্রিল রাজধানীর কচুক্ষেত এলাকার রজনীগন্ধা মার্কেটের স্বর্ণালী জুয়েলার্সে কথিত চুরির অভিযোগে নিঙ্ন নামের এক দোকান কর্মচারীকে গ্রেপ্তারের পর অমানুষিক নির্যাতন করে কাফরুল থানা পুলিশ। নিঙ্ন এখন জামিনে মুক্ত হলেও পঙ্গুপ্রায়। ঘটনাটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে অভিযুক্ত এসআই কামরুল ইসলামকে 'মৃদু শাস্তি' হিসেবে দারুস সালাম থানায় বদলি করা হয়। সবই ঘটেছে যে ওসির নির্দেশে তিনি বহালতবিয়তে আছেন। কেউ কেউ বলছে, ব্যবসায়িক ফায়দা লোটার জন্য মালিক ৭৫ ভরি স্বর্ণালংকার চুরি গেছে উল্লেখ করে একটি মিথ্যা মামলা করেছেন। মালিকের ঘনিষ্ঠজন স্থানীয় একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ এবং সংস্কারপন্থী হিসেবে চিহ্নিত, যিনি ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
গত ৬ জুলাই হরতাল চলাকালে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের এডিসি হারুন অর রশিদের নেতৃত্বে বেধড়ক পিটিয়ে আহত করা হয়। এরপর আলোচনার শীর্ষে পেঁৗছেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা। ঘটনাটিতে সমালোচনার ঝড় ওঠে। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, একসময়ের ছাত্রলীগ ক্যাডার হারুন পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলের নির্দেশে নয়, তাঁর রাজনৈতিক গুরুদের ইশারাতেই ঝাঁপিয়ে পড়েন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের ওপর। এতে সমালোচনার মুখে পড়ে পুলিশ প্রশাসন ও সরকার।
জানা গেছে, গত বছর ১৪ নভেম্বর ফার্মগেট খামারবাড়ী পুলিশ বঙ্রে কাছে দৈনিক কালের কণ্ঠের ক্রীড়া প্রতিবেদক সামীউর রহমানকে পিটিয়ে জখম করে মিথ্যা মামলায় ফাঁসান দায়িত্বরত সার্জেন্ট রাশেদুল। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। ওই সময় খামারবাড়ী এলাকায়ই এক মাসের ব্যবধানে আরো তিন সাংবাদিককে নির্যাতন করে পুলিশ। এসব ঘটনায় ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে পুলিশের। অথচ আজ পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সমালোচনার আরেকটি ঘটনা ঘটেছে গত বৃহস্পতিবার। ওই দিন নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার উমার ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামে মাদকবিরোধী এক অভিযান পরিচালনার সময় পুলিশের লাথিতে আমেনা বেওয়া (৮৫) নামের এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় উত্তেজনা সৃষ্টি হলে পুলিশের সঙ্গে গ্রামবাসীর সংঘর্ষ হয়। গ্রামবাসী ধামইরহাট থানার এসআই মোহসীন আলীকে আটক করে। পুলিশের অন্য সদস্যরা তাঁকে উদ্ধার করতে সাতটি ফাঁকা গুলি ও দুটি টিয়ার শেল নিক্ষেপ করেন। অভিযোগ অস্বীকার করে নওগাঁর ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার আহমারুজ্জামান জানিয়েছেন, পুলিশ দেখে আতঙ্কিত হয়ে বৃদ্ধা মারা যান।
গত বছরও এমন পরিস্থিতি হয় : মাঠপর্যায়ে র‌্যাব ও পুলিশের আচরণ বারবার বেকায়দায় ফেলছে প্রশাসন ও সরকারকে। গত বছরের মাঝামাঝিতে এক সপ্তাহের মধ্যে তিনজনের পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় চরম বিপাকে পড়ে প্রশাসন, সরকার।
গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ হেফাজতে মারা যায় রিকশাচালক মানিক। ২৯ জুন অটোরিকশাচালক বাবুল গাজীকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে রমনা থানার এসআই আলতাফ হোসেনের বিরুদ্ধে। ৩১ জুন গুলশানে মিজানুর রহমান নামের এক ব্যবসায়ী পুলিশের গুলিতে নিহত হন। ২ জুলাই গাবতলী-আমিনবাজার সেতুর পাশ থেকে উদ্ধার হয় মজিবুর রহমান নামের এক পরিবহন শ্রমিকের লাশ। অভিযোগ ওঠে, দারুস সালাম থানার তিন দারোগা হেকমত, মশিউর ও সায়েম ৫০ হাজার টাকা চাঁদার দাবিতে পিটিয়ে ও চুবিয়ে হত্যা করে মজিবুরকে। এ ঘটনায় সাময়িক বরখাস্ত হওয়া অফিসাররা কয়েক দিনের মাথায় চাকরিতে আবার বহাল হন। মজিবুরের মৃত্যুর জন্য অভিযুক্ত এসআই হেকমত পল্লবী থানায় কর্মরত। সম্প্রতি তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ_তিন শিশু নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় স্থানীয় তিন নারী-পুরুষকে থানায় দুই দিন আটকে নির্যাতন করার।
বিশ্লেষকরা যা বলেন : জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, 'যে পুলিশ প্রশাসন দেবে জনগণকে নিরাপত্তা, সেই তাদের দ্বারা একের পর এক নির্যাতনের ঘটনা কারোরই কাম্য নয়। এসব ঘটনায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। অতীতে এ ধরনের ঘটনায় বিচার না হওয়ার কারণে আইন ভাঙার প্রবণতা বাড়ছে।' ড. মিজানুর রহমান আরো বলেন, একের পর এক পুলিশ কর্তৃক সংঘটিত অপরাধের ঘটনা কোনো রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের আলামতও হতে পারে। পুলিশের সব সদস্যই সরকারের মঙ্গল চান_এমনটি নাও হতে পারে। অতীতে অনেক পুলিশকে দেখেছি সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে। আর তাই এখন যেসব ঘটে চলেছে তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. আবদুল হাকিম সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের দেশের মানুষের পুলিশ সম্পর্কে ধারণা সব সময়ই নেতিবাচক। তারা এখন পর্যন্ত এমন কিছু করতে পারেনি যে জনগণ তাদের ওপর আস্থা রাখবে। পুলিশের দ্বারা লাঞ্ছনা, নির্যাতন ও আইন ভাঙার ঘটনা ঘটলে সমাজে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাবে। সাম্প্রতিক সময়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখলেই তা বোঝা যায়। পুলিশে রাজনীতিকরণ এর একটি বড় কারণ। গায়ে ইউনিফর্ম ও হাতে অস্ত্র পেয়েই নিজেকে তারা ক্ষমতাধর মনে করে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। পুলিশ প্রশাসনেও সংস্কার প্রয়োজন।
মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, পুলিশকেই তাদের কাজের মধ্য দিয়ে তার ঐতিহ্য আর ভাবমূর্তি ধরে রাখতে হবে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে যা ঘটছে, তা নিতান্তই দুঃখজনক। পুলিশ প্রবিধান হোক, মানবাধিকার আইন হোক আর দেশের সংবিধানই হোক, সবখানেই বন্দিকে মারধর করা যাবে না বলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। পুলিশ কোনো ক্ষমতাবলেই একজনকে তার হেফাজতে নিয়ে মারধর করতে পারে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং পুলিশের সাবেক আইজি এ এস এম শাহজাহান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ষড়যন্ত্র, বিরোধ যাই থাকুক না কেন নিজেদের ভেতরের ত্রুটিগুলো খুঁজে বের করতে হবে আগে। বিভাগীয় পর্যায়ে চেইন অব কমান্ড এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশের যেসব সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাঁদের ব্যাপারে নিরপেক্ষ তদন্তপূর্বক কঠোর ব্যবস্থা নিলে বারবার অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটবে না।'
পুলিশের আইজি খন্দকার হাসান মাহমুদ বর্তমানে দেশের বাইরে রয়েছেন। তিনি টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে জানান, অপরাধ অপরাধই। পুলিশকে তদন্তের মাধ্যমে এবং তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে অভিযোগ প্রমাণ করতে হবে। মারধর করে তথ্য আদায়ের কখনোই আইনসম্মত নয়। বিচ্ছিন্ন যে কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে, সেটা কেউই কামনা করে না। সংশ্লিষ্ট (অভিযুক্ত) পুলিশদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে, এর পেছনে সরকার বা পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য কোনো মহলের চক্রান্ত আছে কি না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের বদলি, পদোন্নতি, চাকরিচ্যুতি, কথিত ভালো স্থানে পদায়ন_সব কিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় রাজনৈতিকভাবে। সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কাগজে স্বাক্ষর করেন মাত্র। এটা শুধু বর্তমান সরকারের বেলায় প্রযোজ্য নয়, অতীতের সব সরকারের বেলাতেও ছিল। পুলিশ বিভাগে যাঁদের বাড়ি প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির কাছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর বাড়ির কাছে, তাঁরা দাপট দেখাতে ওস্তাদ। তাঁরা তোয়াক্কা করেন না সিনিয়র কাউকে। আর এই গোষ্ঠীভুক্তদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বা উলি্লখিত মন্ত্রীদের পরিচয় বা কোনো সাপোর্ট থাক বা না থাক, তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ওই এলাকার লোক হওয়ার কারণেই অনেকটা সমীহ করে চলেন। ভাবখানা এমন যে উনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এলাকার বা প্রধানমন্ত্রীর এলাকার লোক। অতএব তাঁর কথা না রাখলে বা তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিলে প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাখোশ হয়ে উল্টো তাঁরই ক্ষতি করতে পারেন। ব্যবস্থা না নিয়ে বরং সহায়তা করলে মন্ত্রী মহোদয়রা আরো খুশি হতে পারেন। দেশে এ রকম মনোভাবাপন্ন পুলিশ কর্মকর্তার সংখ্যাই বেশি। আর এসবের কারণে যেটা হয়, সেটা হচ্ছে পুলিশে চেইন অব কমান্ড বলে কিছুই থাকে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ না হলে ভালো কিছুই ঘটবে না। ভালো কিছু আশা করাটাও হবে বোকার স্বর্গে বাস করা।